বাস্তবতা ( একটি কষ্টের ভালোবাসার গল্প )

কষ্টের ভালোবাসার গল্প আমি বর পক্ষের লোক। বর আমার চাচাতো ভাই। বিয়ে বাড়িতে মোটামোটি সবাই আনন্দ করছে। খাওয়ার পর্ব শেষে বর পক্ষের ছেলেরা কনে পক্ষের মেয়েদের সাথে অনেক দুষ্টুমি করছে।

সেই মুহূর্তে মুরব্বীদের আসতে মানা। এটা হয়তো অনেক আগে থেকেই এভাবে চলে আসছে।

আমি একদম আলাদা দাঁড়িয়ে সবার দুষ্টুমি, কথোপকথন, সবই দেখছি ও শুনছি। একটি মেয়েকেও দেখছি চুপচাপ। খুব একটা বেশি কথা বলছে না।

আরেকটি মেয়ের কাঁধে হাত দিয়ে মেয়েটির পিছন থেকে মাথা উঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি দু’বার মনে হয় আমার দিকে তাকিয়েছিল।

মেয়েটিও সুন্দর। তাই আমিও মেয়েটিকে আড়চোখে দেখছিলাম। মেয়েটিও যখন তাকাল তখন চোখ সরিয়ে নিয়েছি। সাথের মেয়েরা প্রচন্ড মজা করছে।

বর পক্ষের ছেলেরাও কম যায় না। তবে আমি যেখানে যাচ্ছি না। এর অবশ্য প্রধান কারণ হলো ওখানে আমি বেমানান।

আমি দরিদ্র পরিবারের ছেলে। আমার চাচা অনেক পয়সাওয়ালা। তবে কারো অর্থ সম্পত্তি কাউকে দিয়ে দেয় না। আর আমার বাবাও কারোরটা নিতে নারাজ, এবার হোক সে ভাই।

বাবার কথা হলো, আমার যা আছে আমি তাতেই সন্তুষ্ট। কষ্টের ভালোবাসার গল্প

এক সপ্তাহ আগে থেকেই আমাদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে। তবে বর যাত্রীতে আমি একাই এসেছি।

প্রথমে আসতে চাইনি। ভালো কোনো কাপড় চোপড় নেই। নতুন কাপড় কেনার মতো অবস্থা বর্তমানে নেই সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি।

বাবার মাসের টাকা দিয়ে সংসার চালাতেই হিমসিম খেতে হয়। আমি দুইটা টিউশুনি করে লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছি, ছোট বোনটারও পড়ার খরচ চালাচ্ছি।

সাদা ফতোয়াটা দেখতে তবুও একটু ভালো লাগছে। এটার গায়েও অসংখ্য ছোটো ছোটো তিলা পড়ে আছে। ঐদিন বৃষ্টিতে ভেজার কারণে এই অবস্থা হয়েছে।

এই ফতোয়াটা পরেই আমি বিয়েতে এসেছি। আমি হাত দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করে তিলা অংশটুকু ঢেকে রেখেছি। সবাই নিজের সম্মানকে একটু হলেও বাঁচাতে চায়।

koster valobasar golpo

মনে মনে দোয়া করছি, বিয়েটা যেন তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। আমি বাড়ি ফিরে যাব।

অনেক অবাক হয়েছি, যে মেয়েটির দিকে বিয়ে বাড়িতে তাকিয়ে ছিলাম সে মেয়েটি ভাবীর সাথে এসেছে।

আমাদের ঘর আর চাচার ঘর পাশাপাশি। তবে তফাৎ শুধু চাচাতো ভাইদের বাড়ি তিনতলা, আমাদের টিনের ঘর।

আমি ভেঙ্গে যাওয়া চেয়ার আর টেবিল তারকাটা দিয়ে ঠিক করছি। একটু পরই চাচাতো ভাইদের বাড়ির ছাদে চোখ পড়তেই দেখি মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমাকে তাকাতে দেখে দৃষ্টি ঘুরিয়ে সরে গেল।

বহুবার বললাম আমি যাব না। তবুও ভাই আমাকে নিয়েই যাবে। বিয়ের দু’দিন পর ওনি ওনার শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে।এখন আমাকেও সাথে যেতে হবে। উলটো বলছে, “মিতু এসে আমাদের বাড়িতে দু’দিন থাকল, তুই যেতে পারবি না কেন?”

হাতে কিছু টাকা ছিল। আর বাঁশের কোটরে কিছু পয়সা জমিয়েছিলাম। সব মিলিয়ে একটি শার্ট কিনে এনেছি আর একজুড়ো জুতো।

এক রিক্সায় ভাই আর ভাবী আরেক রিক্সায় আমি আর মিতু।

অন্য কাউকে সঙ্গে নেয়নি ভাই। গিয়ে হয়তো ঝামেলা পাকাবে, সেই ভয়ে। বিয়ের দিনই ঝামেলা হতে যাচ্ছিল।

যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বসেছি। মিতুই প্রথম কথা বলা শুরু করল….

— আপনি কি সব সময় চুপচাপ থাকেন?

— কই, না তো।

— আপুর বিয়ের দিনও দেখলাম সবাই মজা করছে আর আপনি একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলেন। রিক্সায় আমাদের বাড়ি যেতে সময় লাগবে ৪০ মিনিটের মতো। এতক্ষণ কি চুপ করেই থাকবেন?

— না মানে, এমনি। koster valobasar golpo

— যাই হোক, আমি মিতু। আপু আমার চাচাতো বোন।

— আমি সিয়াম, ভাইয়াও আমার চাচাতো ভাই।

— ( আমার হাতে চিমটি দিয়ে) মিলে গেছে চিমটি।

বলেই মিতু হাসছে। আমি ভাবতে পারিনি মেয়েটা এত স্বাভাবিকভাবে মিশে যেতে পারবে। সারা পথই মিতু আমি অনেক কথা বললাম।

কষ্টের ভালোবাসার গল্প

মিতু একটু পরপরই হেসে ওঠত। আমি শুধু তাকিয়ে থাকতাম। ঐ হাসিতে কোনো ছলনা নেই, প্রানখোলা হাসি।

মিতু আর আমার দূরত্ব অনেকটা কমে এসেছে, এর প্রধান কারণ অবশ্য মিতু নিজেই।

ওদের পুরো এলাকা আমাকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে। দু’জন দু’জনের অনেক বিষয়ে অবগত হলাম।

দু’দিন পর যখন বাড়ি ফিরে আসব তখন মিতুই বলেছিল, আমার ফোন নাম্বারটা যেন দিয়ে আসি।

কীভাবে যেন আমরা অনেকটা কাছে চলে এলাম। প্রতিদিন দীর্ঘ সময় ফোনে কথা বলতাম।

তবে আমি মনে হয় দু’দিন ফোন করেছি। আমার ফোন কেটে দিয়ে মিতুই ফোন দিত।

মাঝে মধ্যে নিজেকে খুব অসহায় লাগত। মিতু মেয়ে হয়ে আমাকে ফোন দেয় অথচ দারিদ্রতার ছোবলের কাছে আমি কতটা অসহায়।

দুই, চার, দশ মিনিট হলে তবুও আমি চেষ্টা করতাম। প্রতিদিন ঘণ্টাব্যাপী কথা বললে তো আমার পক্ষে ফোন দেয়া সম্ভব না।

আমি একবার দু’দিন জ্বরে ভোগছিলাম। মিতু এসে উপস্থিত তার ছোটো ভাইকে নিয়ে। বাড়িতে বলে এসেছে আপুদের বাড়ি যাব। তবে উদ্দেশ্য শুধুই আমি। আমি তখনই বুঝতে পেরেছিলাম যে মিতু আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে।

আগেও যখন ফোনে কথা বলতাম তখন মিতু কথার ছলে আমাকে অনেক কিছু বুঝাতে চাইত।

আমি এড়িয়ে যেতাম। কারণ একটাই, আমার মতো দরিদ্র ছেলে মিতুকে ভালোবাসা মানে চাঁদকে হাতে পাওয়ার আশা করা।

আজ আর আমার বুঝতে বাকি নেই যে মিতু আমাকে সত্যিই ভালোবাসে।

আমি যে মিতুকে ভালোবাসি না তা কিন্তু না। আমিও মিতুকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। বলার মতো সাহস হয়নি, আর কোনোদিন হবেও না।

ভরসার হাত ( রোমান্টিক ভালোবাসা )

koster valobasar golpo

আমি এই প্রথম মিতুর চোখে পানি দেখেছি। মিতু আমাকে ভালো না বাসলে হয়তো কাঁদত না।

আমাকে বিছানায় অসুস্থ অবস্থায় দেখে তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে পানি। বৃথা লুকানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে।

আল্লাহ মানুষকে বড়ো বড়ো বিপদে ফেলে পরীক্ষায় ফেলেন।

হঠাৎ করে বাবা মারা গেল। আমার সারা জীবনে যতটা না কেঁদেছি সেদিন তার চেয়ে বেশি কেঁদেছি। বাবা আমাকে অনেক আদর করত।

খুব বেশি মনে পড়ে, আমি যখন ছোটো তখন অনেক বৃষ্টির পানি জমেছিল। আব্বু আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে পার করতেন। আমি যদি বলতাম, “আব্বু তোমার কষ্ট হয় না?

” তখন আব্বু বলত, “আমাকে যখন তুই কাঁধে নিবি তখন তোরও কষ্ট হবে।”

আবার প্রশ্ন করেছিলাম, “আব্বু তোমাকে কবে কাঁধে নিব?” koster valobasar golpo

বলেছিল, “আমি যেদিন মরে যাব, তুই আরও তিনজনের সাথে সামিল হয়ে আমাকে কাঁধে তুলে নিবি।” সেই দিনটা যে এত তাড়াতাড়া হবে ভাবতে পারিনি।

বাধ্য হয়েই লেখাপড়া ছেড়ে দিলাম। সংসারের পুরো দায়িত্ব আমার কাঁধে।

বাস্তবতা কত কঠোর হতে পারে সেটা আমার চেয়ে ভালো উদাহরন কেউ দিতে পারবে না।

বাস্তব বড়ই নির্মম। মা, ছোটো বোন আর আমি। তিনজনের ছোটো সংসার। সংসার ছোটো হলেও খরচ তো লাগবে।

পেট ভরে তো দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খেতে হবে। ছোটো বোনটার লেখাপড়া।

আমি রাজমিস্ত্রীর কাজ শুরু করলাম। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে বাধ্য হয় মানুষ কাঁটাযুক্ত পথে হেঁটে হলেও সামনে এগিয়ে যেতে।

হঠাৎ করে মিতু একদিন ফোন করে বলছে, “সিয়াম আমার বিয়ের জন্য বাবা-মা পাত্র দেখা শুরু করেছে।

শুনে বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে উঠল।

পরক্ষণেই নিজেকে মানিয়ে নিলাম। বললাম, “এতো খুশির খবর, দাওয়াত যেত পাই আমরা।”

কেঁদে কেঁদে প্রশ্ন করেছিল, “তুমি আমাকে ভালোবাসো না?”

আমি বললাম, “কী বলছ তুমি? তোমাকে ভালোবাসতে যাব কেন আমি। কখনো বলেছি এসব কথা?”

কাঁদতে কাঁদতে মিতু ফোনটা রেখে দিয়েছিল।

কষ্টের ভালোবাসার গল্প

কিছু সময় অনেক মিথ্যে অভিনয় করতে হয়। আমি জানি মিতু অনেক কষ্ট পেয়েছে।

মেনে নিলাম আমি কোনো কষ্ট পাইনি। তবে এছাড়া আমার কোনো উপায় ছিল না।

মিতু ধনী পরিবারের মেয়ে। আমার তো নুন আনতেই পান্তা ফুরায়।

মিতুকে আমি কোথায় রাখব। আমি কোন মুখে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাব?

যতই ভালোবাসি, এখন ভেবে নিব আমি কাউকে কখনো ভালোবাসিনি। ভালোবাসা আমার জন্য নয়।

নির্মম বাস্তবতার কাছে ভালোবাসা বড় অসহায়….

গল্প: বাস্তবতা

লেখনীর শেষ প্রান্তে,,,,,,,

,,,,,,,, ওমর ফারুক শ্রাবণ

Leave a Comment

Verified by MonsterInsights