বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ -বৈজ্ঞানিক পরীক্ষামূলক গবেষণা তথ্যপ্রমাণ


“Supernatural things like ghosts, jinns, fairies exist. Only in stories and fear of the mind.”


উনবিংশ শতাব্দীর দিকে ডারউইন যখন প্রাকৃতিক নির্বাচন এবং প্রকৃতিতে প্রাণীদের লক্ষ লক্ষ বছর ধরে বিবর্তিত হওয়ার বিষয়টি আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করে জনপ্রিয় হতে শুরু করেন, তখন থেকেই অলৌকিকতার ধারণা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে শুরু করে। মানুষ বুঝতে শুরু করে বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ এবং প্রাচীন ধ্যানধারণার মধ্যকার পার্থক্য।


অবশ্য ডারউইনের আরো হাজার বছর আগেই নবম শতাব্দীতে ইরাকি দার্শনিক এবং প্রকৃতিবিদ “আল জাহিজ “ তাঁর বই “দ্য বুক অফ অ্যানিমেলস” গ্রন্থে বিবর্তনবাদের সামান্য ধারণা দিয়েছিলেন।

এই বইতে তিনি লিখেছেন,

“টিকে থাকার জন্যে প্রাণীদেরকে লড়াই করতে হয়। লড়াই করতে হয় তাদের খাদ্যের জন্যেও, এবং তারা নিজেরাই যাতে অপরের খাদ্য না হয়ে যায় সেটা নিশ্চিত করার জন্যে। এমনকি, প্রজননের জন্যেও তাদেরকে সংগ্রাম করতে হয়।”নিজেদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে গিয়ে পরিবেশের নানা কারণে প্রাণীরা নতুন নতুন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে এবং এভাবেই তারা নতুন নতুন প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়।”যেসব প্রাণী প্রজনন ঘটাতে টিকে থাকতে পারে তারা তাদের সফল বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও ছড়িয়ে দিতে পারে।”


বিবর্তনবাদকে থিউরি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে শুরু হয় তথ্যপ্রমাণের জোগাড় করা। আবিষ্কৃত হতে থাকে ফসিল। ধীরে ধীরে বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আরো শক্তপোক্ত অবস্থানে পৌঁছায় বিবর্তনবাদ।

তবে কথা হচ্ছে, আমরা যখনই “বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ” কথাটা বলি, তখন আসলে কি বুঝাই। কিসের ভিত্তিতে আমরা বুঝবো, এটাই যৌক্তিক প্রমাণ। কিভাবে তথ্য সংগ্রহ করে সেটাকে প্রমাণ হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। বৈজ্ঞানিক প্রমাণ কত প্রকার এবং কি কি, সবই আমরা বুঝার চেষ্টা করব।


প্রথমেই বুঝে নিই, বৈজ্ঞানিক প্রমাণ মানেটা কি!!


সহজভাবে বললে- কিছু তথ্য এবং পর্যবেক্ষণের সমষ্টি, যা একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বা অনুমানকে যৌক্তিকভাবে সমর্থন করে। প্রকৃতিতে ঘটা নানান ঘটনা আমরা বিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে পারি। আমাদের হাতে যেই তথ্য থাকবে সেটার সাহায্যে একটা যৌক্তিক বিশ্লেষণ দাড় করানো হবে। সেখান থেকে শুরু হবে নানান গবেষণা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা।


এখানে আবার কয়েকটা বিষয় খেয়াল রাখা জরুরী –

১) তথ্যটা বাস্তব, অর্থাৎ লৌকিক জগৎ-জীবন থেকে সংগ্রহ করতে হবে। কারো ব্যক্তিগত মতামত প্রমাণ হিসেবে গ্রহনযোগ্য নয়। বিজ্ঞান সত্যটা ব্যাখ্যা করা চেষ্টা করে, কারো মতামত/বিশ্বাস-অবিশ্বাস/আবেগ/ অলৌকিক অনুমান এসবে বিজ্ঞানের কিছুই যায় আসেনা।

২) প্রমাণ সংগ্রহে যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হবে, সেসব পরিমাপযোগ্য এবং দৃশ্যমান হতে হবে।

৩) বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়ই হচ্ছে -পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা। বারবার পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে দেখতে হবে, যেই বিষয়টা প্রমাণের চেষ্টা করা হচ্ছে , সেটা সঠিক এবং যৌক্তিক কিনা।

৪) উক্ত বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিজ্ঞানীদের কাছে বিষয়টা উপস্থাপন করতে হবে। তারা নানাবিধ প্রশ্ন করবে, আলোচনা- সমালোচনা করবে এবং যৌক্তিক বিচারবুদ্ধি খাটিয়ে একটা রিভিউ দেবে। সেটা হবে Peer review ।


৫) বিজ্ঞান একটি চলমান প্রক্রিয়া। একটা হাইপোথিসিস বা থিসিসকে বারবার প্রশ্ন করার এবং সন্দেহপোষণ করার উদারচিন্তার অসীম জায়গাটা থাকবে। যেকেউ প্রশ্ন করতে পারবে। বারবার পর্যালোচনা হবে, বারবার নতুন আঙ্গিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হবে। একটা বিষয় সত্য থেকে আরো তিক্ত সত্য হতে থাকবে।




বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ প্রধানত দুই রকম পদ্ধতিতে আসে।

১) পর্যবেক্ষণলব্ধ গবেষণা – গবেষকরা প্রকৃতিতে ঘটা ঘটনাটি খুব মনোযোগ সহ দেখবেন এবং তথ্য সংগ্রহ করবেন। তবে ঘটনায় বাঁধা দিবেন না। যেমনভাবে দর্শক মঞ্চে নাটক দেখে, কিন্তু নাট্যকর্মীদের অভিনয়ে বাঁধা দেয়না। ঠিক তেমন।

একটা উদাহরণ না দিলেই নয়। বিগ ব্যাঙ এর কথাই ধরুন। এই থিউরির ধারণা এলো কিভাবে! মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ থেকেই।

বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার সূত্রের উপর ভিত্তি করে জন লেমিত্রি একটা ধারণা দিয়েছিলেন, হয়তো মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। কিন্তু সেটা তখন বিজ্ঞানী মহলে খুব একটা পাত্তা পায়নি। পরে ১৮৩০ সালে মার্কিন জ্যোর্তিবিদ এডুইন হাবল এবং ডেস্টো স্লাইফার রাতের আকাশে পর্যবেক্ষণ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন, মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের বিষয়টা। তারা পাহাড়ের উপর বড় একটা দূরবীণ বসিয়ে বিষয়টা পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারলেন, গ্যালাক্সিগুলো ক্রমশ আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই ঘটনাটিকে যদি আপনি Rewind করে অতীতের দিকে যান, তাহলে দেখবেন ছায়াপথগুলো আমাদের কাছে চলে আসতেছে। এখান থেকেই প্রমাণ হচ্ছে- মহাবিশ্বের সবকিছু একটা সময় একত্রে ছিলো। ঘন এবং উত্তপ্ত অবস্থায়। ধীরে ধীরে সম্প্রসারণ ঘটেছে এবং সবকিছু পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মেনে তৈরি হচ্ছিলো।


২) পরীক্ষামূলক গবেষণা-

এই কাজটা সাধারণত ল্যাবে করা হয়। যেমন ধরুন – উদ্ভিদ নিয়ে আপনার কাছে একটা হাইপোথিসিস আছে। “সার ব্যবহার করলে উদ্ভিদের বৃদ্ধি দ্রুত হয় “ – এটা প্রমাণ করে থিউরি বানাতে হলে আপনাকে ল্যাবে পরীক্ষা করতে হবে। আপনি আলোযুক্ত কোনো স্থানে দুটি গাছের টব নিয়ে রাখলেন। দুইটা টবেই চারা গাছ আছে। একটাতে সার দিলেন, অন্যটিতে দেন নি। আপনি কয়েক মাস অপেক্ষা করলেন, দেখলেন কোনটার বৃদ্ধি কত দ্রুত হয়েছে। তথ্যটা নোট করলেন। সার নিয়ে আরো বিস্তর গবেষণা করলেন। এভাবেই এই গবেষণাটা এগিয়ে যাবে।


যেসব জিনিসপত্র বৈজ্ঞানিক তথ্যপ্রমাণ হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়।

১) কোনো মানসম্মত জার্নালে প্রকাশিত কোনো রিচার্স পেপার। এই রিচার্স পেপার অবশ্যই পীয়ার রিভিউড হওয়াটা ভীষণ জরুরী।

২) কোনো বিষয়ে কোনো মানসম্মত সার্ভের মাধ্যমে প্রকাশিত কোনো ফলাফলের তথ্য। এছাড়া ছবি, ভিডিও, অডিও রেকর্ড এসবকেও প্রমাণ হিসেবে রাখা যেতে পারে।

৩) কোনো বস্তু, যেমন – পাথর, ফসিল, মাটি, শিলা ইত্যাদি প্রমাণ সংরক্ষণ রাখা হবে।


৪) কোষ, টিস্যু, ডিএনএ, রক্ত ইত্যাদি জীববিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রমাণ হিসেবে সংরক্ষণ হয়।

৫) কোনো প্রজাতীর গাছ, প্রাণী এবং অনুজীবের স্যাম্পল রাখা হয় বোতলের ভেতর।


সুতরাং কেউ যদি দাবি করে বসে, ষাট ফুট লম্বা হাতির অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে ছিলো। তাহলে তার কাছে এই প্রমাণগুলো চাইবেন (হাহাহা ইমোজি)

এবার জানা যাক, কিভাবে এই তথ্যপ্রমাণ নিয়ে কাজ করা হয়।


যদি কোনো রিচার্স পেপার বা ছবি, ভিডিও চিত্র হয়, তাহলে অফিসের মোটা ফাইলে আবদ্ধ পড়ে থাকে। কোনো প্রাণীর স্যাম্পল রাখতে বোতলের লবণাক্ত টাইপ পানিতে সংরক্ষিত থাকে। যখন নতুন কোনো গবেষণায় প্রয়োজন হয়, তখন কাজে লাগে। সাধারণত কোনো প্রাণীর ফসিল পাওয়া গেলে, তখন কার্বন ডেটিং এর মাধ্যমে ফসিলের বয়স বর্তমানের সাপেক্ষে নির্ণয় করা হয়। তাতে বুঝা যায়, ওই প্রাণীটা কোন সময়ে পৃথিবীতে ছিলো। কার্বন, ইউরেনিয়াম এসব পদার্থের ক্ষয় এবং অনুপাত হিসেব করে বয়স নির্ণয় করা হয়।


হাইপোথিসিস – একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা, যেটা গবেষণার আগে প্রাথমিকভাবে দাড় করানো হয়। একটা বিষয় হাইপোথিসিস হতে গেলেও অল্পকিছু যুক্তি প্রমাণ তার পিছনে থাকতে হয়। নয়তো সেটা অলৌকিকতার মতন বেকার চিন্তাভাবনা হবে।
প্রাণের ব্যাখ্যা নিয়ে দুয়েকটি হাইপোথিসিস প্রচলিত আছে। যেমন – RNA World Hypothesis, Hydrothermal Vent Hypothesis।

এছাড়া গ্রাভিটি নিয়ে একটা হাইপোথিসিসের কথা শোনা যায় যে “If gravity is a universal force than it will act the same on the same object anywhere on earth “


থিউরি – থিউরি মানেই প্রমাণিত। বিজ্ঞানের গবেষণায় সর্বশেষ পর্যায় হচ্ছে এই থিউরি। বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফল, বিজ্ঞানীদের আলোচনা-সমালোচনা এবং বিভিন্ন প্রশ্নের আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করে সব যৌক্তিক দিক চিন্তা করে দেখা হয় -বর্তমান তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দাড় করানো ব্যাখ্যাটা যৌক্তিক কিনা। তারপরেও নানান ঝক্কি ঝামেলা আর পরীক্ষা নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে যায়। তবেই সেটা প্রমাণিত বা থিউরি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিজ্ঞানের ইতিহাসে কয়েকটি জনপ্রিয় থিউরি হচ্ছে – Big bang theory, The Theory of Evolution, The Theory of relativity।

এখানে আবার দুটো বিষয় মাথায় রাখা জরুরী। Fact এবং Theory। অনেকেই এই দুটো বিষয়কে গুলিয়ে ফেলেন।

Fact হচ্ছে যেটা আমার সামনেই ঘটছে।

Theory হচ্ছে, আমার সামনে যেটা ঘটছে, সেটা ব্যাখ্যা করা।

যেমন -বিবর্তন ঘটছে, এটা Fact। এবার বিবর্তন কিভাবে ঘটছে, সেটা ব্যাখ্যা করবে থিউরি। কিভাবে করবে? তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে। বুঝা গেলো!!

আরেকটা বিষয় আছে, Law। এটা একটা গাণিতিক বাক্য, যেটা কোনো কিছু কিভাবে ঘটছে বা ঘটবে তা ব্যাখ্যা বলে দেয়। সাধারণত পদার্থবিজ্ঞানে Law এর ব্যবহার বেশি দেখা যায়।

Leave a Comment

Verified by MonsterInsights