‘কই রে মা, আমিনা। এই দ্যাখ, কী এনেছি তোর জন্য।’ সন্ধ্যায় হাট থেকে ফিরেই হাঁকডাক শুরু করে গফুর মিয়া।
পিদিমটা হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে আমিনা।
পিদিমের কাঁপা কাঁপা আলোয় দেখতে পায় বাপের হাতে একটা ছোট্ট পুস্তিকা। সেটার প্রচ্ছদে লেখা ‘মহেশ’। নিচে লেখকের নাম—শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। নিউজপ্রিন্টে ছাপা, নিউজপ্রিন্টেই প্রচ্ছদ।
প্রচ্ছদে একটা রেখাচিত্র, সেখানে একজন বাপ, মেয়ে আর একটা গরুর ছবি আঁকা। অবাক ব্যাপার হলো—ছবিগুলোর আদল—মেয়েটার চেহারা হুবহু আমিনার মতো, বাপটার চেহারা তার বাবা গফুরের আদলে আঁকা। মহেশ তো গরু, ওর আদলটা ধরতে পারল না। ছবিটা যে এঁকেছে, তার ওপর ভীষণ রাগ হলো আমিনার।
মোটেও তাদের চেহারা-শরীর হাড্ডিসার নয়। মহেশের যে ছবি এঁকেছে, সেটাও যেন দুর্ভিক্ষপীড়িত সময়ে কোনো গৃহপালিত পশু যেন। ওদেরকে এমন করে আঁকলই বা কেন? গল্পের নামই বা ‘মহেশ’ হলো কেন? শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নামে এক নবীন লেখক হালে জনপ্রিয় হয়েছেন বটে। কিন্তু ‘মহেশ’ নামে তিনি কোনো গল্প লেখেননি এটা আমিনা জানে। তাহলে কি আজকালই লিখেছেন গল্পটা।
পড়তেই হবে। রাতের রান্না খাবারটা দ্রুত সেরে নেয় আমিনা। বাপকে খাইয়ে মহেশের জন্যও তাজা ঘাস রেখে আসে গোয়ালে।
রাত নিঝুম। ঘন অন্ধকারে ঢেকে গেছে গ্রাম। উঠানের বাঁশঝাড়টা শন শন বায়ু বইছে, তারই ফিসফিসানি শুনতে পায় আমিনা। একটা হুতোমপেঁচা ডেকে ওঠে, ডানা ঝাপটায়। জোনাকির ঝিকিমিকি ছাপিয়ে শিয়ালের হাঁক আসে। সেই গরমের নির্জন রাতে কুপির কাঁপাকাঁপা আলোয় ‘মহেশ’ গল্পে ডুবে যায় আমিনা। ছোট গল্প শেষ হতে সময় লাগেনি। তাদের গল্পই লেখক বলেছেন, একটু অন্যভাবে।
সকালে তার বাবা একটা গল্প বলেন, আশ্চর্য এক গল্প। বললেন, এ বই নাকি এখানকার শরৎচন্দ্র লেখেননি। লিখেছেন অন্য এক মহাবিশ্বের অন্য এক সময়ের শরৎচন্দ্র। এই মহাবিশ্বে যা যা আছে, সেখানেও নাকি সে সব আছে এবং থাকবে। সেখান থেকেই বিজ্ঞানীদের হাতে এসেছে এই বই। কীভাবে গফুর জানে না। প্যারালাল ইউনিভার্স, মাল্টিভার্স ইত্যাদী নিয়ে আমিনা শুনেছে স্কুলের স্যারদের কাছে।
কিন্তু সেই অন্য জগতের কোনো একটাতে তো এমন ঘটতেও পারে। সেখান থেকে এ গল্প এখানে এল কীভাবে?
হঠাৎ বাড়িটা আলোকিত হয়ে উঠল। আমিনা ঘুলঘুলি জানালাটা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে চাকতির মতো কী একটা জিনিস নেমেছে তাদের উঠোনে। তার চারপাশ আলোকিত।
গফুরেরও ঘুম ভেঙে গেছে, দাওয়া থেকে নেমে দেখতে আসে ঘটনা কী?
তর্করত্ন খুড়ো আর জমিদার বাবু স্বয়ং তাদের উঠোনে। আমিনা দরজা খুলে বেরিয়ে আসে। তর্করত্ন আর জমিদার এখন ওর চক্ষুশূল। কারণ এই লোকগুলোর কারণেই শরৎবাবুর গল্পে ‘মহেশ’ মারা যায়। উঠোনের এক কোণে আরেকজনকে দেখে চোখ কপালে ওঠে আমিনার। স্বয়ং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দাঁড়িয়ে। পক্বকেশ, হালকা-পাতলা গড়নের লোকটা। পেপারে অনেকবার এই লেখকের ছবি দেখেছেন। কিন্তু সেই শরৎবাবুর তো চুল পাকেনি, বয়স বেশি নয়। নিশ্চয়ই ইনিই সেই অন্য জগতের শরৎবাবু। ইনিই কি তবে মহেশ গল্প লিখেছেন? আমিনার খুব রাগ হলো, তার বাবাকে দিয়েই এই লোক মহেশকে মেরেছেন। শীতল বাবু আর জমিদারের চেয়ে এই লোক কম খারাপ নয়।
আরেকজন লোক এসেছেন, সাদা সাহেবদের মতো দেখতে। বয়সটাও কম নয়। এই লোক এখানে কেন এসেছেন?
‘এই যে শরৎবাবু, আপনিই করুন বিচারটা, এই ফরাসি লোকটা কী বলছে শুনুন। দুনিয়াটা অতই সহজ?’
‘বললেই হলো!’ এবার তর্করত্ন বাবু গলা চড়িয়ে বলেন, ‘বললেই হলো, বুড়ো ভাম কোথাকার! শরৎবাবু, আপনি বিজ্ঞ মানুষ, আপনাকে ঠকানো অত সহজ হবে না!’ ‘আহা! কী হয়েছে আগে বলুন তো?’
‘আমি বলছি,’ শরৎবাবুকে সেলাম ঠুকে বলেন ফরাসি বুড়ো, ‘আমি বুরিডন শরৎবাবু…’
‘দাঁড়ান, দাঁড়ান!’ শরৎবাবু বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে পারেছেন না, তিনি বললেন, ‘বুরিডন মানে, বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক…?’
‘বিখ্যাত কিনা জানি না, লোকে আমাকে দার্শনিক বলে বটে। আপনি যখন আমাকে চেনেন, তখন আমার ওই তত্ত্বটাও নিশ্চয়ই জানেন, যেটা নিয়ে বিদ্রূপ করেছিল লোকে।’
‘জানি, যেটা নিয়ে প্যারাডক্স বানিয়েছিল লোকে।’
‘হ্যাঁ, আমি সেই বুরিডন। লোকে রটিয়েছে আমার নাকি একটা গাধাও আছে।’
‘গাধা নেই তো কী হয়েছে, গরু তো আছে?’ তর্করত্ন বাবু বলেন।
‘গরু, কস্মিনকালেও আমার কোনো গরু ছিল না।’ বলেন বুরিডন।
‘আপনার না থাকলেও, গফুরের তো আছে?’ জমিদার বাবু বলেন, ‘কী মা, আমিনা, তোমাদের মহেশ কোথায়?’
‘গফুর, আমিনা, মহেশ, আমার গল্পের চরিত্র। এরা সবাই কোত্থেকে এল?’ ভীষণ অবাক হন শরৎবাবু।
‘সে আপনাকে আমরা পরে বুঝিয়ে বলছি, আপনি বরং বুরিডন ঠিক বলেছেন কিনা যাচাই করুন।’ জমিদার বাবু বললেন।
তর্করত্ন বাবু বললেন, ‘কী বুরিডন সাহেব, আরেকবার বলুন না আপনার ওই ভুয়া তত্ত্বটা।’
‘ভুয়া কেন হবে?’ বুরিডন রেগে গেছেন।
‘ভুয়া কি সত্যি, সে পরে দেখা যাবে!’ জমিদার বাবু বললেন, ‘আগে বলুন তো?’
‘হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম,’ শুরু করলেন বুরিডন, ‘যদি দুটো ভালো অপশন মানুষের সামনে থাকে, আর এই দুটোর মধ্যে যেকোনো একটা বেছে নিতে বলা হয়, তাহলে দুটোর মধ্যে তুলনামূলক যেটা ভালো সেটা বেছে নেবে মানুষ। আর যদি নিশ্চিত হতে না পারে কোনটা তুলনামূলক ভালো, তাহলে অপেক্ষা করবে। ততক্ষণ অপেক্ষা করবে, যতক্ষণ না নিশ্চিত হচ্ছে কোনটা ভালো।’
‘আপনার এই উক্তি চমৎকার; তাতে ভুল নেই। কিন্তু এতে সমাজের কোনো উপকার তো হবেই না, উল্টো এই তত্ত্ব সত্যি হলে সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’ জমিদার বাবু বলেন।
‘কীভাবে?’ বুরিডন অবাক।
‘কীভাবে? আমিও জানতে চাই।’ বললেন শরৎবাবু।
‘তর্করত্ন যাও তো, আমাদের স্পেশশিপে দুটো ঝুড়ি আছে নিয়ে এসো।’
জমিদার বাবুর আদেশ পালন করতে দুই মিনিট লাগল তর্করত্ন বাবুর। তারপর জমিদার গফুরকে আদেশ করলেন, ‘গফুর, তোমার মহেশটাকে নিয়ে এসো তো।’
গফুরও দুই মিনিটের মধ্যে আদেশ পালন করল। কিন্তু অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসার সঙ্গে গফুর আর আমিনা চমকে উঠল। এ কোন মহেশ, সিনার সবগুলো হাড় গোনা যাচ্ছে, দুর্বল, কোনোমতে টিকে আছে! বহুদিন যেন খাবার পায়নি। এমন মহেশের কথাই তো পড়েছিল গল্পে।
দুর্বল মহেশকে ছেড়ে দিল গফুর। কিছুটা দূরেই দুই ঝুড়িতে চূর্ণ করা ঘাস। দেখেই বোঝা যায়, একই ঘাস, একই স্বাদের ও একই গন্ধের। শরৎবাবুর মনে হলো জমিদার আর শীতল ভয়ংকর এক খেলা খেলছে। মহেশকে এরা মেরে ফেলবে!
জমিদার বললেন, ‘এখন আমরা দেখব, আপনি যদি ভুল হন তাহলে মহেশের কী ঘটে।’
মহেশের দড়ি ছেড়ে দিল গফুর। দৌড়ে গিয়ে সে একটা ঝুড়িতে হামলে পড়ল। পুরো ঝুড়ির ঘাস সে চেটেপুটে খেয়ে ফেলল। তারপর অন্য ঝুড়িতে মুখ দিল। ‘তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে, বুরিডন,’ জমিদার বাবু বললেন, ‘মহেশ কিন্তু অপেক্ষা করেনি। দুটো ঝুড়িতেই একই রকম খাবার। ভালো-মন্দের জন্য অপেক্ষা করেনি বলেই বেঁচে গেছে বেচারা।’
‘যদি বুরিডন সাহেবের কথা সত্য হয়?’ শরৎবাবু বললেন।
‘সেটাও আমরা পরীক্ষা করে দেখতে পারি।’ বলে জমিদার বাবু কোটের পকেট থেকে একটা রিমোটের মতো ডিভাইস বের করে, তাতে চাপ দিলেন।’ সঙ্গে সঙ্গে পুরো ঘটনা পেছন দিকে ঘটতে লাগল। মহেশের ফুরিয়ে যাওয়া ঝুড়ি আবার ভরে উঠল। মহেশ পিছিয়ে এল গফুরের কাছ পর্যন্ত। গফুর দেখল, দড়িটাও এখন ওর হাতে। এ পর্যন্ত এসে ঘটনা আবার স্বাভাবিক হলো। মহেশ দড়ি টানাটানি করে ছুটতে চাইছে। জমিদার বললেন, ‘মহেশকে ছেড়ে দাও।’ গফুর আদেশ মেনে দড়ি ছেড়ে দিল। তারপর মহেশ কিছুদূর এগিয়ে হঠাৎ থেমে গেল। এমন এক জায়গায়, সেখান থেকে দুটো ঝুড়িরইও দূরত্ব সমান।
মহেশ একবার প্রথম ঝুড়ির দিকে মুখ ফেরায়। শ্বাস টেনে গন্ধ নেয়। তারপর দ্বিতীয় ঝুড়ির দিকে মুখ ফিরিয়ে একই রকমভাবে শ্বাস নেয়। তার করুণ চোখে তাকায় পেছন দিকে ফিরে, গফুরের চোখের দিকে তাকিয়ে।
গফুর কিছু বলে না। মহেশও সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, কিন্তু ক্ষুধায় ছটফট করছে। সময় গড়ায়, ঘণ্টা যায়, মিনিট যায়, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারে না কিছুতেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও দুর্বল হচ্ছে। একসময় বসে পড়ে, যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানেই। আরও সময় যায়, ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে যায় মহেশ। একসময় নির্জীব হয়ে পড়ে। চার পা ছড়িয়ে মারা যায়। আমিনা চিৎকার দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। জমিদার তখন মুখ খোলেন। দেখলেন তো বুরিডন সাহেব, আপনার দর্শন যদি ঠিক হয়, তাহলে মহেশের মতো মানবজাতিও ধুকে ধুকে মরবে।
হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ে। ঘুম ভেঙে যায় আমিনার। তীব্র আতঙ্কে বুক ধড়ফড় করে ওর। জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। ঝুম বৃষ্টি। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকে আলোকিত হয়ে উঠছে গোটা এলাকা। সেই আলোয় ও দেখতে পায়, গোয়ালে নিশ্চিন্তে ঘাস চিবুচ্ছে মহেশ, ওদের তাগড়া মহেশ। তাহলে এতক্ষণ যা দেখছিল, ওগুলো ছিল স্বপ্ন?
পরবর্তী ঝলকানিতে ও উঠোনের দিকে তাকায়। চাকতির মতো স্পেসশিপ, শরৎবাবু, জমিদার, শীতল বাবু, বুরিডন সাহেব, কাউকে দেখতে পায় না। কিন্তু দুটো অদ্ভুত ধরনের ঘাসভর্তি ঝুড়ি পড়ে আছে উঠোনের মাঝখানে।
Source: কালের কণ্ঠ
আজকের এই পোস্ট এ social media তে ব্যাবহার করার জন্য বেস্ট Islamic Status Bangla ও…
Koster Status Bangla Sad Status ১ কাটার দোষ কিভাবে দেই, পা তো আমি নিজেই দিয়েছি..!…
one thing that hopefully most of us can agree on is the fact that the…
অধ্যাপক সত্য চক্রবর্তীর হাত ধরে প্রথম উড়ন্ত ট্যাক্সি পাচ্ছে ভারত।যেটির নাম রাখা হয়েছে ই২০০। ৭-৮…
“Supernatural things like ghosts, jinns, fairies exist. Only in stories and fear of the mind.”…
নওগাঁ জেলার সবচেয়ে বিখ্যাত ঐতিহাসিক স্থান বদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুরে অবস্থিত সোমপুর বিহার। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক…